বাংলা গানের নান্দনিকতার যে শাসন ব্যবস্থা আছে- গভর্ন্যান্স অফ ইসেথিটকস- সেটা আমাদের গানে ভেঙে দেয়া হয়েছে
যায়যায়দিন ,ডিসেম্বর ২০০৯
অরূপ রাহী, রাজনৈতিক ও সামাজিক আন্দোলনে তৎপর এক তরুন শিল্পী। মানুষের সামনে নয়া জীবন আর সমাজের বয়ান হাজির করতে তিনি সংস্কৃতির নানা মাধ্যমে ভর করেন। রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সংগঠক তো বটেই, কবি-গীতিকার-গায়ক ইত্যাদি পরিচয়ও তার জন্য যথার্থ। আন্ত্মর্জাতিক পরিমন্ডলেও কাজ করেন। তবে বাংলাদেশের বাংলা গানের শ্রোতাদের এক বিশাল অংশের কাছে এখন তার সবচেয়ে বড় পরিচয় গায়ক হিসেবে। রাহীরা গান করেন আন্দোলন-সংগ্রামের প্রয়োজনেই। সহযোদ্ধারা মিলে গড়েছেন গানের দল ‘লীলা’। রাজপথে-মঞ্চে-ঘরোয়া বৈঠকে-টিভিতে গানে গানে নয়া জীবন আর সমাজের গান করেন। ২০০৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর লীলার প্রথম অ্যালবাম ‘নায়ক’ বাজারে এসেছে এ বছরের জুলাই মাসে। এর আগে ২০০৭-এ এসেছিল লিপি সরকারের সঙ্গে তার একটি দ্বৈত অ্যালবাম, ‘ভাব বৈঠকি’। সম্প্রতি যায়যায়দিন অফিসে এসেছিলেন নায়কের এ গায়ক। সাক্ষাতকার গ্রহণে মোহাম্মদ আরজু ।
এখন কি কোনো অ্যালবামের কাজ করছেন?
রাহী- এখন কাজ করছি লালন সাঁইজির গান নিয়ে। একদমই আখড়া ঘরানার গান।
কবে নাগাদ আসতে পারে?
রাহী- আমার টার্গেট জানুয়ারি। তবে যারা ডিস্ট্রিবিউট করে তাদের আবার লটের ব্যাপার আছে, তাদের ওপর নির্ভর করবে আসলে। তবে পহেলা বৈশাখের মধ্যে বেরিয়ে যাবে।
এবারো কি জি সিরিজ?
রাহী-এটা এখনো জানি না।
রাহী-প্রযোজক কি বাহিরানা?
না। এটা আমি নিজেই করছি।
বাহিরানার সঙ্গে আপনাদের সম্পর্ক কি?
বাহিরানা আমাদের, মানে লীলার প্রথম অ্যালবামের, নায়কের প্রযোজক।
আপনারা বলেন লীলা উন্মুক্ত গানের দল। তো প্রথম আপনারা নায়ক করলেন, এখন সাঁইজির গান নিয়ে আরেকটা অ্যালবামের কাজ করছেন। আপনাদের একেকটা গান তৈরি হয় কীভাবে?
রাহী-লালনের অ্যালবামটি কিন্তু লীলার না। লীলার অনেকেই ব্যক্তিগতভাবে ওখানে কাজ করছে। কিন্তু ওটা আমার একক অ্যালবাম, আমার প্রযোজনা। তবে গানের দল হিসেবে লীলার গানগুলোর ক্ষেত্রে যেটা হয়; যেমন নায়ক অ্যালবামের কথাই বলি- একেকটা গান একেক সময় একেক কারণে লেখা হয়েছে। লীলার গান মূলত আমিই লিখি।
মানে একটা অ্যালবাম করবেন বলে লেখা হয়নি। পরে একটা অ্যালবামে এসেছে।
রাহী-হ্যাঁ। যেমন ইয়াসমীনের গানটা। দিনাজপুরের নির্যাতিত ইয়াসমীনকে নিয়ে লেখা। এসবই আন্দোলনের সময়, আন্দোলনকে মাঝখানে রেখে লেখা গান। সবগুলো। পরে এগুলো অ্যালবামে এসেছে। তারপর যেমন ‘আমি তোমার মাঝে’ গানটা, ‘৯৫ সালে লেখা। তখন কোনো পরিকল্পনাই ছিল না যে আমি গান করবো। মানে প্রফেশনালী গান করবো। ‘৯৫-এর আগে লেখা গানও আছে। নায়কের কথা বলছি এ কারণে যে ওটা অ্যালবামে এসেছে। আমাদের যেটা হচ্ছে, এখন একটা অ্যালবাম করবো। আসেন দশটা গান বানাই- এভাবে আমরা গান করি না। আমাদের জীবনের অভিজ্ঞতা, অনুভূতি, প্রশ্ন, আন্দোলন সংগ্রামের অভিজ্ঞতা- এসব বিষয়কে ধারণ করার তাগিদ থেকে যেসব গান লেখা হয় সেখান থেকে আমরা পরে নির্বাচন করেছি কোনগুলো অ্যালবামে যাবে।
যন্ত্রসঙ্গীতের পর্বটা কীভাবে হয়?
–যখন দল ছিল না, তখন আমি চোঙা-মাইকে গাইতাম- রাস্ত্মার পাশে, মোড়ে, মঞ্চে। এভাবে এখনো গাই। ২০০৫-এর দিকে গানের দল হিসেবে যাত্রা করলো। কারণ আমরা উপলব্ধি করেছিলাম গান একই সঙ্গে একক ও দলীয় চর্চার বিষয়। যেমন যন্ত্রসঙ্গীতের প্রশ্ন যখন আসে তখন এটা তো আর একা সম্ভব না। আবার একই সঙ্গে এই যে কথা বলছি আমরা গানে, সেটা যদি একটা দলের চেতনা থেকে ধারণ করি, তাহলে পরে দল ও সমাজের ওপর সেটার একটা প্রভাব পড়ে।
অ্যালবাম বা আপনাদের আন্দোলন-সংগ্রামের প্রয়োজন ছাড়া কোনো ব্যক্তিগত উদ্যোগে আয়োজন করা হলে সেখানে কি আপনারা গান করেন?
সাধারণত আমরা এমন আয়োজনে যাই না। বিশেষ কোনো কারণ থাকলে হয়তো। ধরা যাক, হয়তো আপনি বললেন যে আমরা লালনের গান শুনবো, কথা বলবো, বুঝবো। তখন তো যাই।
টিভিতে …
রাহী-হ্যাঁ। টিভি তো যাই।
কিন্তু আপনার তো টিভি নাই।
রাহী-আমার টিভি নাই। হে হে হে …।
তাহলে আপনাদের প্রোগ্রাম আপনি দেখেন না?
রাহী-পরে কখনো দেখি, কখনো দেখি না। কোথায় হয়তো কাছে বন্ধুর বাসা ইত্যাদি থাকলে দেখে ফেলি।
গত অ্যালবামের গান তৈরি করার সময় সম্ভাব্য শ্রোতা হিসেবে কাদের কথা খেয়ালে এসেছিল বেশি। অর্থাৎ সামাজিকভাবে কোন শ্রেণী আপনাদের গান শুনবে বলে আপনাদের আন্দাজ ছিল? কিংবা কাদের আপনারা বিশেষভাবে শোনাতে চেয়েছিলেন?
রাহী-একদমই আমার সময়ের গান আমি লিখছি। সুতরাং আমি এটা আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকেই শোনাতে চাইবো। ফলে প্রথমত একদমই নতুনদেরই আমরা শোনাতে চেয়েছি। কথার দিক থেকে দেখলে, সুরের দিক থেকে দেখলে, গানের পুরো শরীরের দিকে তাকালে দেখলে দেখবেন- বাংলা গানের নান্দনিকতার যে শাসন ব্যবস্থা আছে- রেঝিম/ গভর্ন্যান্স অফ ইসেথিটকস- সেটা আমাদের গানে ভেঙে দেয়া হয়েছে। আমাদের গানের শরীর একদম আলাদা। নতুনদের জন্য। অবশ্য এ অবস্থান নিয়ে অনেকের আপত্তি আছে। এ বিষয়ে আমাদের অবস্থান হচ্ছে; আমরা বাংলা গান করি। বাংলা গানের যে জায়গা, যে ধারাবাহিকতা, বিভিন্ন অর্থে- সেখান থেকে হেমাঙ্গ বিশ্বাসও আমাদের ঐতিহ্য, আমরা নজরুলেরও উত্তরাধিকার, রবীন্দ্রনাথের উত্তরাধিকার, লালন সাঁইজিরও।
হেমাঙ্গ আপনার প্রিয় শিল্পীদের একজন।
রাহী-সেটাই। এ জায়গা থেকে আমাদের প্রধান নজর থাকে যে বাংলা সুর ঠিক হচ্ছে কি না। বাংলা গানের সুর আমরা কোথা নিয়ে যেতে চাই সেটা আমাদের খুব খেয়াল থাকে। একই সঙ্গে বাংলা গানের কথা কী হবে, সে জিনিসটা আমাদের চিন্ত্মার মধ্যে থাকে। আমরা দাবি করি- আমরা বাংলা সুরে রক গান করছি। লোকে ড্রামস আর ইলেকট্রিক গিটার বাজলেই সেটাকে ব্যান্ড বলে। আমরা ওরকম ফিঙ্ড মেম্বারশিপের ব্যান্ড না। আমরা গানের দল। কথা, সুর, যন্ত্র, সদস্য কোনো দিকেই আমাদের অচ্ছুৎ জ্ঞান নেই। বাংলা গান হচ্ছে কি না সেটা আমরা খেয়াল রাখি। সেক্ষেত্রে আমরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করবো। গানে আমার বক্তব্য প্রকাশের জন্য যে যন্ত্র সবচেয়ে কাজে দেয় সেটাই আমরা ব্যবহার করতে রাজি আছি।
ছয় মাস তো হয়ে গেল আপনাদের প্রথম অ্যালবামের বয়স। এখন কি মনে হচ্ছে, আপনাদের পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফল কেমন? কাঙ্খিত শ্রোতাদের পাওয়া গেছে? ব্যবসায়িক সাফল্য কেমন?
রাহী-ব্যবসায়িক সাফল্যের কথায় পরে আসি। এ প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা আমাদের জ্ঞান লুফে নিয়েছে, পুরনোদের চেয়ে অনেক বেশি। আমাদের বন্ধু-বান্ধব যারা আমাদের গান নিয়ে চিন্ত্মা করে, আমাদের সমালোচনা করে, তারা আমরা সবাই মিলে অবাক হয়েছি। তরম্নণরা আমাদের গান অনেক ক্রিটিকালি অ্যাপ্রিশিয়েট করছে। শুনছে, গানের কথা নিয়ে কথা বলছে। আমাদের গানের কথা দিয়ে নিজেদের ফেসবুক স্ট্যাটাস দিয়ে রাখছে, আপনি নিজেও দেখছেন। সুতরাং আমাদের সময়ের যে ভাষা, সেদিকেই আমরা আছি বলে মনে হচ্ছে।
ব্যবসায়িক সাফল্য?
রাহী-বাংলাদেশের অডিও শিল্পের কথা আপনি জানেন, এটার কোনো মা-বাপ নেই। কোনো গণতন্ত্র নেই, ন্যায্য-অন্যায্য বলে কিছু নেই। যে যেভাবে পারে আর কী! লুটপাট চলে এখানে। ব্যবসা-বাণিজ্য নেই। ফেয়ার বিজনেস বলে কিছু নেই। তারপরও আমাদের প্রযোজক ‘বাহিরানা’ আর পরিবেশক ‘জি-সিরিজ’র সুবাদে আমরা এখনো ভালো সাড়া পাচ্ছি।
এ পর্যন্ত্ম অ্যালবামটি লাভজনক হয়েছে?
রাহী-এটা তো ছয় মাসে বলা যায় না। প্রবণতা আছে। বাজারে ইতিবাচক সাড়া পাচ্ছি আমরা।
এমনিতে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আপনাদের গানের দল হয়েছে। সে জায়গা থেকে ‘অলাভজনক’ প্রতিষ্ঠান হওয়ার কোনো ইচ্ছা কি আপনাদের আছে?
রাহী-অলাভজনক হওয়ার কিছু শর্ত থাকে। অ্যালবাম করার যে খরচ সেটা আমাদের কে দেবে? আমাদের সে সামর্থ্য নেই। যে অ্যালবামটা প্রযোজনা করবে, পরিবেশন করবে, তার তো খরচটা উঠে আসতে হবে। ওই অর্থে লোকে অ্যালবাম কিনে শুনুক সেটাই আমরা চাই।
বিভিন্ন ওয়েবসাইট থেকে আপনাদের গান ডাউনলোড করা যায়, সেটা কি আপনাদের অনুমতিতে হচ্ছে?
রাহী-না, না। এটা সাইটওয়ালারাই করছে। বাংলাদেশের কপিরাইট আইনে এটা অবৈধ। এভাবে হলে পরে অ্যালবামের খরচ উঠে আসা মুশকিল হয়ে যায়। আমরা অবশ্য এটা নিয়ে জোরাজুরি করি না। পারলে আমরা শ্রোতাদের গান ফ্রি দিতাম।
এখন কি সেটা সম্ভব নয়?
রাহী-একটা পুঁজিবাদী সমাজে একজন শিল্পীকে বাঁচতে তো হবে। আর্থিক ফেরতের জন্য নয়, আমাদের টিকে থাকার জন্যও আর্থিক লাভের প্রশ্ন আছে। এ কারণেই শ্রোতারা কিনে গান শুনুক সেটাই আমরা উৎসাহিত করি।
নায়ক-এর গান শুনছিলাম, অন্য একজনের সঙ্গে। অ্যালবামের দ্বিতীয় গানটিতে এসে- পিয়াসা পাথর অঙ্গে কেন জাগালে হে… পর্যন্ত্ম এসে গায়কের অপেক্ষায় না থেকে দোস্ত্ম আমার নিজেই যোগ করে দিল ‘প্রভু’। অর্থাৎ পিয়াসা আমার পাথর অঙ্গে কেন জাগালে হে প্রভু। কিন্তু আপনার গানটিতে সেখানে ‘প্রভু’ নয় ‘প্রাণ’। অথচ তারপরই ‘প্রভু হে, দয়াময়, প্রাণনাথ প্রাণ’। প্রাণ আর প্রভু মেলাতে পারছে না আপনার তরম্নণ শ্রোতা। আপনার কি মনে হয়, মুশকিলটা কোথায়? অনেকেই গান বুঝতে পারছে না।
রাহী-হ্যাঁ। অনেকেই বলেছে যে তারা গানের কথা বুঝতে পারছে না। এখানে দুটো ঘটনা আছে। একটা হচ্ছে- বাংলাদেশে এখন গানের কথার মান এতো নিচে এটা নিয়ে কথা বলারই সুযোগ নেই। এখানে কবিতার চর্চা হচ্ছে না। কবিতা না হলে ভালো গানের কথা আসবে কোত্থেকে। সুতরাং গানের কথা ভালো হলে পরে সেটা এ রকম সমস্যা হবেই। দ্বিতীয় ঘটনাটি হচ্ছে- আমরা গানগুলোতে বাংলাদেশের মানুষের জীবনের অভিজ্ঞতা আর অনুভূতি ধারণ করেছি। এটাতে অনেক শ্রোতাই অভ্যস্ত্ম নয়। হালকা কথার পুতুপুতু গানের শ্রোতারা কিছুটা সমস্যায় পড়েছেন।
আমাদের অভিজ্ঞতা- আপনি যেভাবে ‘অতর্কিতে ছন্দ শাসন’ ভেঙেছেন সেটা শ্রোতারা আমলে নিয়েছে। যেমন সব সুরের ধরনে শ্রোতারা অভ্যস্ত্ম, সেসবের বাইরে এসে এমনকি আপনার নিজস্ব গায়কী তারাও উপভোগ করছে। কিন্তু গানের ভাষা তাদের কাছে অপরিচিত। যেমন ওই গানটা- ‘যদি আমায় আইতে কও দুপুর বেলা মুরগি রাইন্ধো না’, সেখানে যে মানুষটি নায়কের সঙ্গে সংসার বাঁধার স্বপ্ন দেখছে তাকে কেন নায়ক ‘বিশ রকমের শাক’ রেধে দিতে চাচ্ছে কিংবা ‘পঞ্চডালের সুবাস দিয়া’ ঘর ভরাতে চাচ্ছে সেটা আমার মনে হয় শ্রোতারা ঠিক ধরতে পারছে না। এ রকম নায়কের সঙ্গে শ্রোতারা পরিচিত না। যে নায়ক সোনার-কিষান, যুথে ফসল তোলে যুথে বপন করে; অথচ সে নায়কই দাবি করে, আলো তার স্বভাবের সীমানা ভেঙে তার পায়ের পাশে হাঁসফাঁস করে মরবে। এ সময়ে দাঁড়িয়ে হয়তো ‘কিষাণ-নায়ক’ এর কল্পনা শ্রোতাদের কাছে অসম্ভব মনে হয়। আপনার নিজের অভিজ্ঞতা কেমন এ ব্যাপারে।
রাহী-একটা বড় অংশের শ্রোতাদের কানে এটা বাংলা গানে, বাংলাদেশের অভিজ্ঞতায় একটা নতুন ঘটনা। যে নায়ক তার প্রিয় মানুষকে বিশ রকমের শাক রেধে দিচ্ছে, যে নায়ক ছেঁড়া মশারি বাঁধে- এই যে অভিজ্ঞতা, জীবনের অভিজ্ঞতা এভাবে বলা, এতে শুরম্নতে অনেকেই মুশকিলে পড়েছে। তারপর কিন্তু এ অংশটা ঠিকই আমাদের গান গ্রহণ করেছে। কারণ তারা টের পেয়েছে এইটাই তো ঘটনা, এই তো আমাদের জীবন। আবার অনেকে কিন্তু শেষ পর্যন্ত্ম আর গানগুলো নিজেদের করে নিতে পারেনি। কারণ এ নায়ককে গ্রহণ করতে হলে নিজের ভেতরও একজন নায়ক থাকা চাই, আত্মসম্মান, আত্মচেতনা থাকা চাই। সেটা যাদের মধ্যে নেই তারা আর মুশকিল কাটিয়ে উঠতে পারেনি। মানুষ হিসেবে, সংবেদনশীল মানুষ হিসেবে এ রকম নায়কের জীবন যারা চান তারা কিন্তু গানের কথার সঙ্গে এ অনভ্যস্ত্মতার বিপদ কাটিয়ে উঠেছেন শেষ পর্যন্ত্ম। এ নায়ক কিন্তু প্রচলিত পুরুষতান্ত্রিক অর্থের পুরুষ কিংবা নারী নয়। এ প্রচলিত অভ্যস্ত্মতার যে সংস্কৃতি, সবকিছু মেনে নেয়ার সংস্কৃতি, এর বাইরে দাঁড়িয়ে যে মানুষের সঙ্গে নিত্যকার আনন্দ ভাগাভাগি করে বাঁচে সেই নায়ক। এ বোধ কারো হলে পরে সে কিন্তু নায়ককে নিয়ে দ্বিধায় পড়ছে না। এখন যখন অনেকেই মঞ্চের সামনে আমাদের গানের সঙ্গে গলা মেলান তখন বুঝতে পারি- বোধের মানুষ আছে। অনেক।
এ নায়ক মাংসপোলাও পছন্দ করেন না কেন?
রাহী-আপনি দেখবেন পুরো অ্যালবামজুড়ে নায়ক নতুন প্রেম আর নতুন আনন্দের জন্য বিদ্রোহ করেন। সে জায়গা থেকে দেখলে …। আপনি প্রশ্নটা আবার করেন …
ওই যে ‘দাওয়াত’ গানটা- ‘আমার ভালস্নাগে না বসতবাড়ি মাংসপোলাওময়/ তাই আমার সাথে স্বপনও সংসার তুমি বাইন্ধো না।’ নায়ক প্রিয় মানবীকে বলছে যে, তুমি যদি মাংসপোলাওময় বসতবাড়ি ভালোবাসো তবে আমার সঙ্গে সংসার বাঁধার স্বপ্ন দেখো না। কেন?
রাহী-‘মাংসপোলাও’ শব্দে মাংসপোলাও নামের খাবার জিনিসটিকে বোঝাইনি। এখানে ভোগবাদীতার যে জীবনযাত্রা সেটাকে সমালোচনা করা হয়েছে। নায়ক ভোগবাদী সমাজে থাকতে চায় না। অ্যালবামের সব গান মেলালে পরে দেখবেন- সেই এ সমাজ থেকে বেরোতে চায়, সবাইকে নিয়ে এবং নতুন সমাজ গড়তে চায়। যেখানে প্রেম করপোরেট দুনিয়ার ঠিক করে দেয়া সংজ্ঞা ও পরিধির বাইরে, পণ্যের বেঁচাকেনার ওপর যেখানে সংসারের সম্পর্ক দাঁড়ায় না। যে প্রেমে নতুন জীবনযাপনের আকাঙ্ÿা আছে।
নতুন প্রেমের কথা?
রাহী-হ্যাঁ। আমাদের প্রশ্ন- ‘কাকে তুমি প্রেম বলো বলো ইতিহাস/ বারম্নদগন্ধ নাকি ফুলের সুবাস/রক্ত বন্যা ঝড় মিছিল নাকি মৃতদের নাম লেখা মুর্দাফরাস’। আমরা বলছি, প্রেম-জীবন-বিদ্রোহকে নতুন করে চেনা দরকার। এ দরকার প্রসঙ্গে যারা অন্ত্মত চিন্ত্মা করতে চায়, তৎপর হতে পারম্নক বা না পারম্নক, তাদের জন্য এ অ্যালবামটা। এবং আমরা গানের দল হিসেবে আমরা সত্যিকার অর্থে একটা নতুন জীবনযাত্রার ডাক দিই। যে জীবনে এ নির্বিকার ভোগবাদ থাকবে না।
আপনারা লীলাকে যৌনবাদ(সেক্সিজম)বিরোধী বলেন।
হ্যাঁ। আমরা চাই ভালোবাসা থাকবে জীবনযাত্রার নিয়মিত অনুশীলনের মধ্যেই। লাভ অ্যাজ প্রাক্সিস। এমন জীবনযাপনের কথা আমরা বলি যেখানে মানুষের মধ্যে পারস্পরিক সেবা-সম্মান-মর্যাদা থাকবে। বিনয় থাকবে। যৌনবাদ-এ এটা সম্ভব না।
নায়ক অ্যালবাম থেকে আমরা যে কোনো একটা গানের কথা ছাপতে চাই। আপনি কোনটাকে প্রাধান্য দেবেন?
‘নায়ক’ গানটাকেই। শ্রোতারা এটাই সবচেয়ে বেশি নিয়েছে।