‘ফতোয়া’ বিষয়ে আমাদের সমাজে ভীতি, সন্দেহ , উৎসাহ ইত্যাদি কাজ করে নানান তরফে। ইসলাম ও শরিয়া- এসবের বহুমাত্রিক বিকাশ ও চর্চার ইতিহাস সম্পর্কে প্রয়োজনীয় সামাজিক ও গণতান্ত্রিক জ্ঞান চর্চার অভাব, কায়েমি এলিটতন্ত্রের হাতে এ বিষয়ের একক ও প্রশ্নাতীত এজেন্সি থাকা, সেসবের জাহেলি ও বেইনসাফি চর্চা এসবের কারন । এর প্রধান দায় আমাদের, ‘অতনব্বইভাগ’বাদী, জাতিবাদী- পরিচয়বাদী এই সমাজের।’ফতোয়া’ দেয়া কেবল ‘ইফতা’ পড়া বা ‘ইফতা’ ডিগ্রির বিষয় না। আরবী থেকে পাইকারি বাংলা করার ব্যাপার নয়। দ্বীন-দুনিয়া, ইসলাম- শরিয়া, ভাষাতত্ত্ব- অনুবাদতত্ত্ব, সমাজ-ইতিহাস-সংস্ক্রিতি সম্পর্কে ব্যাপক ও গভীর পান্ডিত্যের বিষয়, বহুশাস্ত্রীয় এবং ইনসাফি ইলম আর হিকমার বিষয়।ইউটিউবে গেলে বাংলাদেশ/বাংলাভাষাতেও আপনি বিপুল ফতোয়া চর্চার উদাহরণ পাবেন- বিভিন্ন মাহফিল এবং প্রোগ্রাম থেকে এসব দেয়া হয়। হ্যা, বাংলাদেশেও বহু ভিন্ন মতের ফতোয়া চর্চা আছে, সেটা জীবন বিধান ও দ্বীন চর্চার বিভিন্ন প্রসঙ্গ – অনুসংগেই। কিন্তু সাধারণভাবে সেসবে দুনিয়ার হালনাগাদ তত্ত্ব-দর্শন- সমাজ-ইতিহাস বিদ্যার প্রজ্ঞার সাথে এঙ্গেজ করার উদাহরণ নাই বললেই চলে।ফতোয়া যে কত বিচিত্র রকম হইতে পারে- গুগুল করতে পারেন। দুনিয়ার বদল দুনিয়াবী বহুবিচিত্র অভিজ্ঞতা এবং দ্বীন- ধর্ম-ইসলাম ও শরীয়া সম্পর্কে বুঝ-ব্যাখ্যা বদল হাজারো ফতোয়ার জন্ম দিতেছে। ছবি তোলা -টিভি দেখার হালাল-হারাম, ছবি আকা- গান গাওয়া – ভাস্কর্য বানানি থিকা শুরু কইরা, মেছও্যাক- টুথব্রাশ- স্যান্ডেল- পর্দা- বউ পিটানো- সুদ-ঘুষ-বিবাহ, কুকুর পালা – অনলাইন / টেলিফোনে নিকাহ/বিবাহ, ‘ভিন্নধর্মী’মানুষের সাথে মেলামেশার তরিকা, ‘গণতন্ত্র’ হালাল-হারাম পর্যন্ত। ‘বেদাত’ এর তালিকায় কি ঢুকবে- কি ঢুকবেনা- ফতোয়া আছে অগনিত। প্রতিদিন আসতেছে।মুমিন-মুসল্মানের ভিন্নমতে আল্লাহর নিয়ামত বর্ষিত হবার সম্ভাবনা। শর্তঃ ইলম/জ্ঞান/প্রজ্ঞার চর্চা। তাই, মুসলিমদের মধ্যে, সমাজের যেকোনো মত-পথ-বিশ্বাসী কমিউনিটির মতই, ভিন্নমত থাকলে, কোনো বিষয়ে ভিন্ন ভিন্ন ফতোয়া আসলে সেটা সমাজে সামাজিক/ গণতান্ত্রিক/ সম্মিলিত ভাবে জ্ঞান- প্রজ্ঞার চর্চায় দিয়া সেসবের মীমাংসা/ব্যবস্থাপনা্র বিষয়। কেন্দ্রীয় কর্ত্রিপক্ষ অনেকেই চান এসব মীমাংসার জন্যে। তার ফল দুনিয়ায় কেমন কেমন হয় বা হইছে- আগ্রহীরা খবর নিতে পারেন। ‘গণতন্ত্র’ হারাম / কুফরি/হালাল ইত্যাদি ফতোয়া পাবেন। সারা দুনিয়াতেই বহু জন এই ফতোয়া দিতেছেন বহু যুগ ধইরা। উলটা ফতোয়াও আছে, ভিন্ন ভিন্ন মতের অনেক ফতোয়া আছে রাষ্ট,গণতন্ত্র, ভোট ইত্যাদি সম্পর্কে। সেসবের অনেক ফতোয়া বিপুল পান্ডিত্যপুর্ণ, বহুশাস্ত্রীয় জ্ঞান চর্চর ও প্রজ্ঞার প্রতিফলন আছে অনেকের ফতোয়ায়।যাই হোক। এই যে একই প্রশ্নে ভিন্ন ভিন্ন ফতোয়া- এটা কেমনে সম্ভব হয়, হইলে কে কোন ফতোয়া মানবে বা মানবেনা- এসবের ‘আইনগত ‘ বাধ্যবাধকতা কি- এসব প্রশ্ন আমাদের আমমধ্যবিত্তের আছে।ফতোয়া কোনো বিষয়ে ‘ধর্মীয়বিধানগত’ বিবেচনা থেকে দেয়া একক বা গোষ্ঠীগত/ সম্মিলিত রায়/নির্দেশনা/মতামত বা রুলিং। সবক্ষেত্রে তা বিশ্বাসী’র মানা-না-মানার অব্লিগেটরি/ বাধ্যবাধকতাযুক্ত না, বরং ভিন্ন ভিন্ন বিধান / ব্যাখ্যা/ অনুশীলনের দল বা মাজহাব বা সম্প্রদায় ইত্যাদির নিজস্ব স্বাধীনতার ব্যাপার ।ধর্মীয় বিধি-বিধানের বুঝ-ব্যাখায় ভিন্নতা ও বৈচিত্রই একই প্রশ্নে ভিন্ন ভিন্ন ফতোয়ার উতস। কোনো ফতোয়া ‘রাষ্ট্রীয় আইন’ আকারে জারি না হইলে তা মানার ‘আইনী বাধ্যবাধকতা’ সাধারণভাবে কোনো রাষ্ট্রে বিশ্বাসীদের নাই। এটা ফতোয়ার একটা প্রধান আইনগত পরিসীমা। ‘ধর্মীয় চর্চা’ হিসেবে ফতোয়া দেয়া-নেয়া, মানা-না- মানা সব সময় ইসলাম ও শরিয়ার বুঝ-ব্যাখ্যা-ভাষ্য- অনুশীলনের দল, মাজহাব, ধারা-উপধারা ইত্যাদির নির্ভর করে আসছে। ‘রাষ্ট্র’ যতক্ষন একটা বহুজাতি-বহুধর্ম-বহুভাষার- বহু পরিচয়ের, বহুমতের মানূষের সমাজের ‘গণতান্ত্রিক’ তথা, অংশগ্রহণ্মুলক, প্রতিনিধিত্বমুলক, দায়বদ্ধতার অধীন, ‘ধর্মীয়’ রুলিং বা ফতোয়া জারি করা , কায়েম করা তার এক্তিয়ার/কর্তব্যের মধ্যে পরে কিনা- তাও শরিয়া ও ফিকহ শাস্ত্রবেত্তাদের বিপুল বিতর্ক-বাহাসের বিষয়, যার সর্ববাদীসম্মত কোনো মীমাংসা হয় নাই এখনো। ‘ফতোয়া’ তাই বিশ্বাসীর ব্যক্তিগত ও কমিউনিটি’ পরিসীমার নানামাত্রায় মানা-না-মানার বিষয় হিসেবেই থাকে এমন ক্ষেত্রে। ‘ ‘ইসলামী রাষ্ট্র’ ধারণাটাই ঔপনিবেশিকতা প্রভাবিত- এমন মতের পক্ষে শক্তিশালী যুক্তি-আলোচনা আছে। এই ধর্ম-রাষ্ট্র সম্পর্কটা ‘সেক্যুলারিজম’ বিতর্কের একটা অংশ। এ বিষয়ে রসদ পাবেন ‘লোকায়ত’ সাইটে। লিঙ্ক পাবেন মন্তব্যের ঘরে।ছবি-মুর্তি-ভাস্কর্য বিষয়ে ফতোয়া দিতে আগ্রহীদের জন্যে কিছু রসদ যোগাড় করছি, তারও লিঙ্ক আছে মন্তব্যের ঘরে। ২/দ্বীন-ধর্ম-ইসলাম- শরীয়া বুঝের বহুভিন্নতা আছে সারা দুনিয়ায়। থাকাটাই স্বাভাবিক। একটা প্রধান চ্যালেঞ্জ হইলোঃ ঔপনিবেশিক আধুনিকতা মোকাবেলা। সেখানে জটিলতা হইলোঃ ঔপনিবেশিক আধুনিকতার প্রভাবের বাইরে গিয়া কিভাবে নিজেদের এসব বোঝাপড়ার পর্যালোচনা করা যায়। শরিয়া সম্পর্কে পরিচয় ও পর্যালোচনামুলক পাঠের তালিকার লিঙ্ক পাবেন মন্তব্যের ঘরে। তো, ঔপনিবেশিক আধুনিকতা যে পরিচয়বাদ/সঙ্খ্যাগরিষ্ঠতাবাদ/পুজিবাদ/ লিংগব্যবস্থা/জ্ঞানব্যবস্থা/আধুনিক রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রপ্রকল্প তৈরীতে নির্ধারক ভূমিকা রাখলো- এসব ব্যবস্থা/চর্চা/আদর্শ/প্রকল্প/প্রতিষ্ঠানের বাইরে আমরা কিভাবে নিজেদের দ্বীনী বুঝ হাজির করবো/নির্মান করবো- যা দেশ- দুনিয়ায় শান্তি, মঙ্গল, ন্যায়-ইনসাফ আনতে ভূমিকা রাখবে, সেটা খুবি জটিল এবং কঠিন , বহুমাত্রিক সাধনারই ব্যাপার।উপনিবেশ/সাম্রাজ্যবাদ আমাদের মজলুম করছে, প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া স্বাভাবিক, কিন্তু প্রতিক্রিয়াই শেষ কথা এবং ‘স্বাভাবিক’ হইলে আমরা জালিম হয়ে উঠি, কারন, প্রতিক্রিয়া স্বাভাবিক হয়্ব ওঠার সাথে একটা নতুন ক্ষমতা পত্তন হইতে থাকে। যার সুবিধা সমাজে কায়েমী হইতে থাকে।এসব থিকা বের হওয়া কঠিন। কিন্তু জুলুমের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা, ন্যায়-ইনসাফ প্রতিষ্ঠার সাধনা করা- জ্ঞান/প্রজ্ঞা/জীবন চর্চার সবখানে, খুব কঠিন।”ওয়য়ার অন টেরর’ মডেল চলতে পারতেছে যে এখনো, ‘ সেক্যুলার’- ‘এন্টি -সেক্যুলার’ জোড়-বিপরীতের বিজনেস যে চলতে পারতেছে- তার প্রধান একটা কারন আমাদের, দুনিয়ায় এই জ্ঞানগত/ ভাবগত/ সাংস্কৃতিক / রাজনৈতিক সীমাবদ্ধতা।আমরা জ্ঞাতসারে/অজ্ঞাতসারে এই মডেল এবং জোড়-বিপরীত ব্যবহার করে চালু থাকা জুলুমশাহীর নাটবল্টু/চালক/পরিচালক ভূমিকা পালন করতেছি।’উন্নয়ন’, ‘চেতনা’ আর ‘অনুভুতি’ ব্যবহার, উপঢৌকন -নজরানা – জালিমি ক্ষমতার লেনদেন-ভাগাভাগি দিয়া চলা এই জুলুমশাহীঃ গুম-খুন-ভোটডাকাতি-বিচারহীনতা-ধর্ষনতন্ত্র- পুঁজিবাদ – পুরুষতনত্র- গায়ের জোরবাদ/ সঙ্খ্যাগরিষ্ঠতাবাদ- পরিচয়ফ্যাসিবাদ – সেখানেও আমরা অনেকেই কায়েমীর পক্ষে ভূমিকা রাখি, প্রতিবাদ করিনা। এসবের বিরুদ্ধে গভীর পান্ডিত্যপুর্ণ একক, বহুজনের বা সম্মিলিত ‘ফতোয়া’ পাই না যে, এসব থিকা আমাদের সমাজে ‘দ্বীনী ইলম চর্চা’র হাল- হকিকত ও কায়েমী অবস্থা/ চর্চার হাল-পক্ষ কিছুটা আন্দাজ করতে পারি। জুলুমশাহীর দেশে সঙ্খ্যাগরিষ্ঠতার সুবিধা-ক্ষমতাপ্রাপ্ত সমাজের দ্বীন চর্চার দায়-দায়িত্ব অনেক বড়। পদে পদে তার ন্যায়- ইনসাফ চর্চার চ্যালেঞ্জ। সাম্য-ন্যায়-ইনসাফের জন্যে লড়াইয়ের চ্যালেঞ্জ। হক্কুল্লাহ- হক্কুল ইবাদ বোঝা ও চর্চার চ্যালেঞ্জ।তাই সেদিন বলছিলাম যে, পারলে ভাষামুর্তি ভাংগো, ভাষাপ্রতিমার বাইরে যাও, ধর্মবুঝের ঔপনিবেশিক-পরিচয়বাদী-কেন্দ্রবাদী ভাস্কর্য ভাংগো। এই ব্যাপারটা বুঝলে জুলুমশাহির বিরুদ্ধে, গুম-খুন- ধর্ষন-লুটপাট-ভোটডাকাতির বিরুদ্ধে, ধর্ষনতন্ত্র- পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে, সাম্য-ইনসাফ-গণতন্ত্রের পক্ষে লড়া্র দ্বীনী দায়িত্ব বোঝা যায়।জুলুমশাহী থিকা মুক্তি পাইতে আমাদের ইনসাফি ইলম চর্চার, তার সামাজিক অনুশীলন গভীর করার তৌফিক দিন- পরম করুনাময়ের কাছে এই নিবেদন।