বাম গণতান্ত্রিক জোট গঠিত হবার পর নাগরিক-বুদ্ধিজীবীদের সাথে একটা মতবিনিময় সভায় আমাকে দাওয়াত দেন শ্রদ্ধাভাজন সাইফুল হক। আমি সেখানে যাই মুলত জানতে বুঝতে এবং শিখতে। এক পর্যায়ে আলোচনার জন্যে আমার নাম প্রস্তাব করা হলে আমি ধন্যবাদ জানাই জোটের উদ্যোগের জন্যে, জানাই যে এই জোট গঠনের উদ্যোগ আমার মত অনেকেরই উৎসাহের এবং আশার কারন ।

তবু, বামরাজনীতির বিকাশের প্রশ্নে আমি বিনয় সহকারে, আমার দায় নিয়েই কিছু পর্যবেক্ষন এবং মতামত জানাই। যার মোদ্দা কথা ছিলো, ব্যতিক্রম বাদে, মোটাদাগে, বাংলাদেশের বাম্পন্থী রাজনীতির কাগজপত্র-লিখাবলা এবং চলা দেখলে বুঝা যায়: শ্রেণী, রাষ্ট্র, রাজনৈতিকপ্রতিষ্ঠান বা পলিটি, জাতি, জাতীয় মুক্তি ও জাতীয়তাবাদ, লিঙ্গ এবং লৈঙ্গিক রাজনীতি, উপনিবেশ এবং ঔপনিবেশিকতা, প্রগতি আর বিপ্লব প্রশ্নে দুনিয়ার চিন্তা এবং অনুশীলনের জগতে যত পরিবর্তন এবং অর্জন হইছে, ব্যতিক্রমবাদে বাংলাদেশের বাম্পন্থা সেসবের ধারে কাছে যাওয়া তো দুরের কথা, খোজ খবরও পর্যাপ্ত রাখেনা।

উদাহররণ আকারে, বিশেষ কইরা সেক্যুলারিজম প্রশ্নে গড় বাম্পন্থা যেসব ধ্যান ধারণা পোষন এবং লালন করে, তা দুনিয়ার ওয়্যার অন টেরর প্রকল্প এবং তার ‘সেক্যুলারিজম’-এর বয়ান আর পলিটিক্সের মধ্যে বান্ধা পইড়্যা যায়। এসব থিকা বের হবার তাগিদ দেই আমি।

আরো কিছু কথার মধ্যে এও বলি যে, জাতীয় সম্পদরক্ষাসহ সামাজিক এবং জাতীয় ইস্যুতে নানান আন্দোলনে বামের জোরালো ভূমিকা থাকলেও ‘বাস্তব’, ‘ক্ষমতা’র রাজনীতিতে বামের ব্যররথতার কারন অনুসন্ধান করা দরকার, যদি ক্ষমতা নেয়াকে বাম অপবিত্র জ্ঞান না করে। ন্যুনতম ‘বুর্জউয়া গণতন্ত্র’ যেহেতু বামজোটের ন্যুনতম লক্ষ্য, তাইলে যেকোনো দলের স্বৈরতন্ত্র থিকা কেম্নে সমাজকে বাইর করা যাবে? সেটা মন্দের ভালো কিংবা আপদ-বিপদ তত্ত্ব দিয়া না বুইঝ্যা শ্রেনী এবং জাতীয় প্রশ্নের সম্মিলন- তথা গণতান্ত্রিক পলিটি বিকাশের রাজনীতির মাধ্যমে করা দরকার মনে করি বলে জানাই।

বলি যে, যেকোনো প্রকার, যেকোনো দল/জোটের স্বৈরতন্ত্র মোকাবেলা এবং দেশকে গণতন্ত্রের দিকে নিয়ে যাবার জন্যে বাস্তব পদক্ষেপ কি- সেটা নিয়ে ভাবা দরকার। জনমত-জনস্বার্থ, জনঅভিজ্ঞতা, সামাজিক বাস্তবতা এবং নিজদের আদর্শ- উদ্দেশ্য- সাংগঠনিক ক্ষমতাকে কোন মাত্রায় কি সম্পর্কে বাঁধলে ক্ষমতার এবং ব্যবস্থার আশু পরিবর্তন হয়- সেটা ভাবা দরকার- এটাও বলি সেদিন।

এও আমরা দেখি, যে, বাংলাদেশের মধ্যবিত্তকেন্দ্রিক বামরাজনীতির একটা বড় বৈশিষ্ট হইলো জলাচল ধর্ম আর ছুতমার্গ।

এর মধ্যে, কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন ‘জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া’র নাগরিক সমাবেশে জোনায়েদ সাকির হাজির হওয়া নিয়ে বাম মহলে বেশ আলোচনা হচ্ছে। সব মিলায়ে, বাংলাদেশে বাম রাজনীতি এক ক্রান্তিলগ্নে। যাহোক, বামজোটের মতবিনিয়ময় সভায় আমার ২ মিনিটের বক্তবের সাথে আজকে আরো কিছু প্রশ্ন/পয়েন্ট যোগ করা দরকার মনে করি। এসব প্রশ্নের আলোচনা, উত্তর খোঁজা আজকের বাংলাদেশের বাম্পন্থী রাজনীতিতে লড়াইয়ের সংহতির জন্যে প্রয়োজনীয় বোঝাপড়া তৈরীতে সাহায্য করবে বলে মনে করি।

পয়েন্ট গুলার মধ্যে আছেঃ
-নৈতিকতাবাদী( মরালিস্ট/ moralist) রাজনীতি কি কোনো অর্থেই মার্ক্সবাদী রাজনীতি – যখন কিনা তার সাথে ব্রাম্মন্যবাদী পুরুতঠাকুরের ইস্টনাম জপের মিল? নাকি মার্ক্সবাদী রাজনীতি এথিক্স( ethics) তথা চলার নিয়মের কথা বলবে? মার্ক্সবাদী রাজনীতি কি মরালিষ্ট, না কি এথিক্যাল?

– আমাদের ‘সেক্যুলারিজম’ কি হিন্দু এলিটের বর্ণবাদী- ব্রাম্মন্যবাদী সেক্যুলারিজম? যা আদতে ধর্ম তথা ইসলাম বিদ্বেষী?

-শ্রেণী বলতে আমরা বিশুদ্ধ কোনো সর্বনাম বুঝি ? যেমন ‘শ্রমিক’ , ‘কৃষক ‘ ‘বুর্জুয়া’ , ‘সামন্ত’ ইত্যাদি? শ্রেনীকে আমরা নিরঞ্জন অর্থে নিতেছি না তো? এটা ভূল। শ্রেনী একটা সর্বকালের জায়মান ব্যাপার। তাই একই ‘শ্রেনী’তে ভিন্ন ভিন্ন প্রবণতা, লক্ষ্য, অভিজ্ঞতা ইত্যাদির দেখা মেলে। ফলে, শ্রমিকতা, ক্রিষকতা, বড়লোকি- ইত্যাদিকে যান্ত্রিক , অচল-অবশ বস্ত হিসেবে দেখা মানে মানুষের বহু সম্ভাবনাকেই বাতিল করে দেয়া । লিংগ যেমন তরল এবং সামাজিক-সাংস্ক্রিতিক নির্মিতির ব্যাপার, শ্রেনীও তেমন। সমাজে প্রতিনিয়ত এই নির্মিতি চলে, গড়ে, ভাঙ্গে। ধীরে কিংবা জোরে।

-কখন শ্রেনী প্রশ্ন আর জাতীয় কর্তব্য প্রশ্ন এক হয়া যায়? জাতীয় সম্পদ রক্ষার লড়াই আমরা কেন করি? গৃহযুদ্ধ কাদের পক্ষে আর কাদের বিরুদ্ধে যায়? মার্ক্সবাদী রাজনীতির কাঠামোয়, বুর্জুয়া গণতন্ত্র এবং বুর্জুয়া পলিটি চিরন্তনভাবে গণবিরোধী? কখন, কোন মুহুর্তে শ্রমিক/ক্রিষক/নিপীড়িত জনতার কর্তব্য হয় ন্যুনত্ম গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্যে লড়া?

– সেই লড়াইয়ে আমরা কাকে বাদ দিবো আর কাকে দিব না? কার সাথে আলোচনা/বৈঠকে বসবো আর কার সাথে বসবো না? সমাজের নানা ধর্ম-বর্ণ-জাতি-লিঙ্গের-শ্রেণির সাথে আমার ‘বিপ্লবী’ রাজনিতি শুধু জলাচলের রাজনীতি করবে চিরকাল? আমি ছাড়া বাকি সবাই অশুদ্ধ, পাপী, বিধর্মী, ছোটলোক? এই নৈতিকতার কষ্টিপাথর আমি কবে হইলাম? কেন হব?

– আমাদের মুক্তিযুদ্ধের, ইতিহাসের একটা মাত্র ন্যারেটিভ বা বয়ান, যা কিনা গণবিরোধী, তা মেনে চলতে বাধ্য করায়, একটা কোনো দলীয় স্বৈরতন্ত্র বহাল রাখার পক্ষে আমার জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে ভূমিকা রাখে, তখন আমার করনীয় কি?

-সমাজের কোন অংশকে ফেলে দিয়ে আমি বিশুদ্ধ ‘কমিউনিস্ট-বাম্পন্থী-সমাজতন্ত্রী-দেশপ্রেমিক-উদারগণন্ত্রী’র সাথে ঐক্য করবো? এই ব্র্যাকেট এবং হাইফেন কি কি শর্তে লম্বা হয়?

– ধরাযাক এখন বাংলাদেশে সঙ্খ্যানুপাতের ব্যবস্থায় ভোট হইলো, আমরা কত আসন আর ভোট পাবো ? বাকীদের সাথে আমরা পার্লামেন্টে বসবো ? সেখানে আলাপ-সংলাপ হবে না? বিশেষ কোনো মুহুর্তে তাদের সাথে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ , ‘ সাম্য’ , মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্খা’, ‘ সমাজতন্ত্র’ , ‘ শ্রমিক- কৃষকের স্বার্থ’ ইত্যাদি প্রশ্নে কখনোই অন্য কারো সাথে আলাপআলোচনা করার দরকার হবেনা? সংসদ, পলিটি, গণতন্ত্রিক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান কখন গড়ে তোলা দরকার, কখন কোন মাত্রায় পরিবর্তন হওয়া দরকার- তা কিসের ভিত্তিতে ঠিক হবে? কারা সেকাজে নেতৃত্ব দিবে? ইত্যাদি। অলমতি বিস্তরেনঃ ।

এক সনের মুক্তিযোদ্ধা যেমন চিরকালের মুক্তিযোদ্ধা না, এক্কালের বাম্পন্থীও চিরকাল বাম্পন্থী না। ইতিহাসের কাদামাটি গায়ে না লাগানোর যে বিশুদ্ধবাদী পথ, তা কখনই ইতিহাস বদলায় না। সুদুর ভবিষ্যতের লক্ষ্যে কাজ করা মানে বর্তমানের ভূমিকা ভূলে যাওয়া নয়। বর্তমান দূরে রেখে সুদুরের পিয়াসী হইলে অদুর-সুদুর কোনোখানেই ঐতিহাসিক রাজনৈতিক কর্তব্য করা সম্ভব হয় না। সুদুর ভবিষ্যত আজকের বর্তমানতার উপরে দাঁড়াবে। বরং, সুদূর লক্ষ্যকে সামনে রেখে বর্তমান বদলাতে থাকার রাজনীতিই বিপ্লবী রাজনীতি। এটাই ইতিহাস দেখার , বদলানোর বস্তবাদী পথ। তাতে ইতিহাসের কাদামাটি গায়ে লাগে। সেসব চিহ্ন ধরেই ইতিহাস রচিত হয়। আমরা যেন সেই ইতিহাসের স্বাক্ষী হইতে পারি।
‘পাবিরে অমূল্য নিধি, বর্তমানে’।

বামজোটের চ্যালেঞ্জ হইলো এসব দার্শনিক, রণ্নৈতিক এবং কৌশলগত দিক বুঝে জনগণের মধ্যে গণতান্ত্রিক ঐক্যের পথ বিকশিত করা।

সেটা বর্তমান বাম না পারলে ইতিহাস অন্য পথ নিবে। অথবা নতুন বাম রাজনীতি সমাজে বিকশিত হবে। গণতন্ত্রের দার্শনিক এবং রাজনৈতিক বোঝাপড়ার লড়াই যেমন করতে হবে, তেমনি বর্তমানে হাজির হওয়া গণতন্ত্রের জন্যে লড়াই করেই যেকোনো বামকে সমাজে নিজের জরুরত এবং ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। অন্য পথ নাই।

সংহতি।