পরিচয়ফ্যাসিবাদ ও জুলুমশাহীর বাংলাদেশঃ শরীয়ত সরকার গ্রেফতারের কালে কয়েকটা মন্তব্য
[ সম্পাদনা চলবে]
‘কটুক্তি’, ‘অবমাননা’র মত অনির্দিষ্ঠ, অসংগায়িত ‘অপরাধে’র অভিযোগে এত দ্রুত শরীয়ত সরকার এবং আরো অনেকের গ্রেফতার-রিমান্ডের সাথে বাংলাদেশে আরো একটা -দুইটা রাজনৈতিক – পরিচয় রাজনীতির সংগে যুক্ত মানূষদের গ্রেফতার-রিমান্ড-গুমের এত মিল আর ভোট-ডাকাতি, ধর্ষন , টাকা-পাচার, ব্যাংক লুট, নদী-বন-পাহাড়-বাতাস-জমি ধ্বংসের হোতাদের এত আরাম আর এত জুলুমকারি ক্ষমতার ভোগ-উপভোগ– কোথাও আমাদের ইমান-এহসান- জ্ঞান-প্রজ্ঞা-ইনসাফের বোধ ধাক্কা খায়?
শরিয়ত বয়াতির মুক্তি চাই আমরা, কিন্তু এটা যথেষ্ট না। ভিন্নমত- ভিন্ন রুচি পোষনের অধিকার, ভোট, শ্রমের মুল্য পাবার অধিকার, দূষণ – অমর্যাদা-বিচারহীনতামুক্ত সমাজ-জীবন নির্মানের সংগ্রামটা আমাদের হয়ে অন্য কেউ কি করে দিবে?
এহ বাহ্য।
#
জুলুমশাহী যে নামেই চলুক- তা নিজে ফ্যাসিস্ট এবং অন্যসব রকম ফ্যাসিস্ট প্রবণতার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদদাতা, জমিন তৈরীকারী। বাংলাদেশের সমাজে ফ্যাসিবাদী প্রবনতার কয়েকটা রূপ আছে মিলেমিশে। এখানে তার একটা রুপ-ধরণ যা বেশ প্রত্যক্ষগোচর, তা হইলো #পরিচয়ফ্যাসিবাদ যা জাতি-ধর্ম পরিচয়ের মানুষের #সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদীফ্যাসিবাদীজুলুম , #ভাগেরবড়াইবাদীজুলুম । এসব নিয়া আমার মত-মন্তব্যের একটা সংগ্রহ এখানে পাবেন, আগ্রহীরা দেখতে পারেনঃ https://bit.ly/2FIXRUM ।
চলমান জুলুমশাহীর প্রধান একটা প্রক্রিয়াগত কারনঃ ঔপনিবেশিক- প্রান্তিক / লুন্ঠনকেন্দ্রিক পুঁজিবাদ, ঔপনিবেশিক জাতি/ধর্ম/পরিচয় ও রাষ্ট প্রকল্প। এর কারনে ‘আইনের দ্বারা শাসন(যেমন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, নানারকম ইম্যুনিটি দেয়ার আইন ইত্যাদি)’ আর গণতন্ত্রহীনতা, বিচারহীনতা- যা পরিচয়ফ্যাসিবাদের জমিন ক্রমাগত শক্ত করতেছে , পরিচয়ফ্যাসিবাদের ওপর ভর করে চলতেছে অগণতান্ত্রিক সব সরকার। গণতন্ত্রহীনতা সমাজে যোগসাজশভিত্তিক প্রতিশোধ পরায়নতা বা এই অর্থে ষড়যন্ত্রভিত্তিক নানান জুলুম, দ্রুত প্রতিশোধ , দ্রুত পুণ্যলাভ, অর্থকড়ি লাভ করার ইচ্ছা-চর্চা বাড়াইতেছে প্রতিনিয়ত- পরিচয়ফ্যাসিবাদ এখানে কো-অপারেটিভ।মানুষের শরীর-মন-রক্ত-জমি-প্রতিবেশ- সব কিছুই এই প্রক্রিয়ার প্রভাবের মধ্যে আছে। কেউ শহীদ, বেশিরভাগ মজলুমঃ বহু নাম-পরিচয়-অভিজ্ঞতায়। অনেকেই মজলুমের নাম নিয়ে জালিম।
এহ বাহ্য।
#
পশ্চিমা ঔপনিবেশিক আধুনিকতার পাটাতনে জন্ম নেয়া/ নির্মিত হওয়া / বিকাশ লাভ করা ধর্ম-জাতি-পরিচয়-রাষ্ট- ধারণা ও ব্যবস্থা, তার বর্ণবাদি- পুঁজিবাদ এবং পুরুষতান্ত্রিক মাত্রা , বিশ্বঔপনিবেশিক-পুজিবাদী অর্থনীতির মধ্যে বাংলাদেশের প্রান্তিকতাঃ সব মিলায়ে চলমান জুলুমশাহী তৈরি । এখানে উপনিবেশ- পশ্চিমা আধুনিকতার, তার পুজিবাদের সাথে বিভিন্ন ট্র্যাডিশন/ধর্ম/প্রতিবেশ/ইতিহাসের ঘাত-অভিঘাতের জটিল স্কিজোফ্রেনিক জীবন/ অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়া যাচ্ছি আমরা। উদাহরণ হিসেবে কয়েকটা ধারা/প্রবনতা/প্রক্রিয়ার উল্লেখ এখানে করা যায়ঃ দ্বীনের নামে/ ধর্মের নামে ‘আরবাইজেশন’-এর চাপ, বাংগালী সংস্ক্রিতির নামে বর্ণহিন্দুর কিছুমাত্র রুচি- দৃষ্টিভঙ্গি চর্চার চাপ, আধুনিকতার নামে পশ্চিমা ঔপনিবেশিক ‘সেক্যুলারিস্ট’ জীবন বিন্যাসের চাপ, ‘ওয়ার অন টেরর’ মডেল ও প্রকল্পের চাপ, ভারত রাষ্ট্রে ‘হিন্দুত্ববাদ’-এর উত্থানের চাপ- এরকম আরো বহু রাজনৈতিক – সাংস্ক্রিতিক প্রক্রিয়ার চাপ আমাদের সমাজ-জীবনে চলতেছে ।
এর মধ্যেই চিন্তার, ভাবার, আত্মপোলব্ধিরঃ জ্ঞানচর্চার, সাধনার, উপাসনার, আরাধনার, ভাব-ভাবনা প্রকাশের সময়, পদ্ধতি, উপায়( গান-কবিতা-ছবি-নাচ-তর্ক-বাহাস ইত্যাদি), অবকাশ, পরিসর- সবি ধ্বংস – ভাংচুর- প্রতিনিয়ত পুনর্বিন্যাসের মধ্য দিয়া যাইতেছে। খোদ এইসব জীবনপদ্ধতি এবং অভিজ্ঞতার জটিল ইতিহাসকেই এক লহমায় অস্বীকার, বাতিল, অবৈধ এবং অপরাধ হিসেবে দ্রুতই সাব্যস্ত করা হইতেছে পরিচয়ফ্যাসিস্ট ধারাগুলি থেকে, ঔপনিবেশিক-ফ্যাসিস্ট কায়দায়। পালাগান- কবিগান( যার প্রধান ফর্ম/ধরণ/আকারই হইলো পক্ষে-বিপক্ষে বাহাস করা, তর্ক-ভাষ্য হাজির করার মাধ্যমে ‘পার্ফর্ম’করা), ভাবসঙ্গীতসহ জ্ঞানচর্চা,ভাবচর্চা, উপাসনা-সাধনাার, জীবনের নানা ধরণ, এর সাথে জড়িত মানুষজন-কমিউনিটি এই ঔপনিবেশিক- আধুনিক ধর্মবোধপ্রভাবিত পরিচয়ফ্যাসিস্ট জুলুমের শিকার।
এই বহুমাত্রিক ঘটনাপ্রবাহে প্রাণ হারানোসহ বহু্রকম জুলুমের শিকার হচ্ছেন মর্মগতভাবে উপনিবেশিক আধুনিকতা বিরোধী, পরিচয়ফ্যাসিবাদ বিরোধী, পুজিবাদ -পুরুষতন্ত্র বিরোধী, প্রেম- ভালোবাসার- বন্ধুত্ব-মুক্তির, দ্বীন-ধর্ম-উপাসনার-সাধনার দেশ-সমস্যাভিত্তিক বিবেচনার মানুষজন, ঔপনিবেশিক ও তার আধুনিকতা প্রভাবিত জীবন ও ক্ষমতাসম্পর্কের বাইরের নিবাসী, অধিবাসী, আদিবাসী মানুষজন।
#
ধর্ম- দ্বীন-রিলিজিওন-উপাসনা-আরাধনা- পরিচয়-সংস্কৃতির ধারণা- অনুশীলন-রুপান্তরের ইতিহাস যেমন, তেমনি, ‘বাংলাদেশের’ ‘৯৮ভাগ/৯৯ভাগ মুসলমানের দেশ’ হওয়ার , নির্মানের, রুপান্তরের ইতিহাস-রাজনীতি-প্রক্রিয়া-প্রভাবও সমানভাবে ভাবা জরুরী এই বিশ্ববাস্তবতায়, যদি ইলম, জ্ঞান আর প্রজ্ঞার দাবী রাখতে চাই ইনসাফ আর ইহসানভিত্তিক। সেটাই বাংলাদেশে প্রায় গড় হাজির। এই পরিস্থিতি থেকে বের হবার, জ্ঞান-ইলম-ন্যায্যতা-ইনসাফের, জীবন এবং ইতিহাসের কোনো বিউপনিবেশিক- বোঝাপড়ার ইমানি- এহসানি উদ্যোগের গভীর অনুপস্থিতি লক্ষ্য করার মত।
#
মুসলিম পরিচয়ের মানুষেরা নিজেদের দ্বারা মজলুম তো শুধু পুরুষসহ সব মানূষ শ্রেনী হিসেবে হই-তা না– নারীসহ বিভিন্ন লিংগ পরিচয়/বৈশিষ্টের মানূষেরাও মুসলিম পরিচয় কমিউনিটির মধ্যে জুলুমের স্বীকার হই যুগ যুগ ধরে। এর অঙ্গে এবং বহিরঙ্গে আরো ব্যাপার আছেঃ সেই কবেকার বৌদ্ধ নিধন, বাংলা অঞ্চলে ধর্মান্তর/ইসলামের প্রসার পর্ব, উপনিবেশের কালে ও পরকালে বাউল-ফকির ধ্বংস ফতোয়ার রাজনীতি, বহুকাল ধরে বাউল-ফকির-সহজিয়া-সুফি-তরিকাপন্থী-নিম্নবর্ণ/নিম্নবর্গ ‘হিন্দু’-আদিবাসীসহ আচার- আরাধনা-জীবনভাবনায়-অভিজ্ঞতায় ভিন্নতর কমিউনিটির মানূষেরা যে সংখ্যাগরিষ্ঠের জ্ঞাত-অজ্ঞাত ভাব-ভাষা-সমাজ-রাষ্ট অনুশীলনের চাপ ও জুলুম বহন করতেছেন- তার কারন-প্রক্রিয়া বিচার করার ইমানি দায়িত্ব আমরা কয়জন পালন করা দরকার মনে করতেছি? বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠতার পরিচয়ের চেতনা এবং অনুভূতিওয়ালারা কি ভূলেও এই ভাবনা কমিউনিটি আকারে ভাবে, যে, সে কতভাবে নিজ এবং অপর কমিউনিটির উপর জুলুম করতেছে? তারা নিজেরা কতমাত্রায় জালিম?
#
সেক্যুলার/ফান্ডি/ওয়য়ার অন টেরর জটিলতার আলাপ আর এখানে আনলাম না। আগ্রহীরা সে প্রসংগে এই নোট দেখবেনঃ https://bit.ly/2FKiEHm ।
#
এসব দিক বিবেচনা করেই কেবল বিউপনিবেশিক সাম্য, মর্যাদা, ইনসাফ আর গণতন্ত্রের সমাজ -দেশ-ব্যবস্থা কায়েমের সাধনা পারি আমরা। আসেন, চেষ্টা করি সবাই মিলে। পরম করুনাময় আমাদের সংগ্রাম-তদবির কবুল করুন।
আলেক সাঁই ।
[ সম্পাদনা চলবে]
১৩/১/২০২০।